কারা সেই ক্রেতা, যাঁরা আসেন মুন্নিদের কাছে? মুন্নি জানাচ্ছে, বেশিরভাগই আসে কলেজছাত্র। তবে আইনজীবী, রেস্তোরাঁ মালিক, ট্যাক্সি চালক থেকে শুরু করে ছাপোষা মধ্যবিত্ত, কিছু বিদেশি পর্যন্ত আসেন তাদের কাছে।
সমাজ তাঁদের চিহ্নিত করেছে ‘পতিতা’ নামে। তাঁদের বসতিস্থলও তাই চিহ্নিত ‘পতিতাপল্লি’ হিসেবে। কিন্তু তাতে তাঁদের মানবিক পরিচিতিটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আনন্দ-বেদনা— সবকিছুই আর পাঁচটা মানুষের মতোই।তারাও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। তারা আমাদের মতনই মানুষ, ভিনগ্রহের প্রাণী নয়।
কেমন রয়েছেন নিষিদ্ধপল্লির সেই মেয়েগুলি? কেউ কি খোঁজ রাখে!!
সেখানকারই এক পতিতা মুন্নি। মুন্নি আসলে বাংলাদেশের মেয়ে। বাংলাদেশের মুন্নি যখন ১৩ বছরের ,তখনই এক রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক যুবক তাকে তার মা বাবার থেকে আলাদা করে বাংলাদেশ থেকে কলকাতার সোনাগাছিতে তাকে পাচার করে দেয়। তার পর থেকে সোনাগাছিতেই কেটে গিয়েছে তার পাঁচ বছর।
বাবা-মার কথা এখন সে ভুলে গিয়েছে প্রায়। আজ তার মহিলা দালালটিকেই ‘মা’ বলে ডাকে সে। তিনি ভালবাসেন তাঁকে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় কিনে দেন শাড়ি। এখন মু্ন্নির বয়স ১৮। কিন্তু দালাল ‘মা’-এর পরামর্শে ‘খদ্দের’দের কাছে সে নিজের বয়স বলে ২০ বছর।
সোনাগাছিতে আসার পরে একেবারে প্রথম দিনগুলির অভিজ্ঞতা এখনও ভুলতে পারে না মু্ন্নি। সোনাগাছিতে এক মাসির ঘরে এনে তোলে মুন্নিকে। সেই মাসি প্রথম কয়েকদিনেই ভাল ভালে পোশাক-আশাক আর খাবার-দাবারের বিনিময়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন মুন্নির। মুন্নি বোঝেওনি কী উদ্দেশ্যে তাকে আনা হয়েছে এখানে। কিন্তু সোনাগাছিতে আসার তৃতীয় দিনে মুন্নিকে আরও জনা কুড়ি মেয়ের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল রাস্তায়।
প্রথমটায় মুন্নি ভেবেছিল নতুন কোনও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে বুঝি তাদের। কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙে তার, সে বুঝতে পারে ‘খদ্দের’ ধরার জন্য দাঁড় করানো হয়েছে তাকে। বোঝা মাত্রই পালানোর চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু মাসির লোকজন তাকে ধরে ফেলে। একটা অন্ধকার ঘরে বেশ কয়েকদিন বন্দি করে রাখা হয় তাকে। একটা মোটা লাঠি দিয়ে মারধোরও করা হয়। মানসিক নির্যাতন করা হতো। তবে এখনও মনে আছে মুন্নির, কিছুতেই তার মুখ, বুক বা উরুতে কোনওরকম আঘাত করা হত না। ওইসব জায়গায় আঘাতের দাগ পড়লে শরীরের বাজারে ‘দাম’ পড়ে যাবে যে তার।
মুন্নি জানাচ্ছে, বছর দুয়েক আগেও প্রতি ক্রেতার কাছ থেকে ঘন্টা প্রতি হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেত সে। তেমন তেমন মেয়েরা পেত ঘন্টা প্রতি ছয়-সাড়ে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু এই দু’বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। ব্যবসা আর এখন আগের মতো চলে না। তাই মাসির নির্দেশে সব মেয়েই এখন তাদের ক্রেতাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নেয়। রোজগারের ৫০ শতাংশ দিতে হয় মাসিকে।
কারা সেই ক্রেতারা যাঁরা আসেন মুন্নিদের কাছে? মুন্নি জানাচ্ছে, কর্মচারী ,আইনজীবী, রেস্তোরাঁ মালিক, ট্যাক্সি চালক থেকে শুরু করে ছাপোষা মধ্যবিত্ত, এমনকী কিছু বিদেশি পর্যন্ত আসেন তাদের কাছে।
সোনাগাছিতে তো এখন অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে বলে শোনা যায়। তাদের কথা জানে মুন্নি? মুন্নি বলল, জানে সে। এনজিও-গুলি নিয়মিত প্রচারসভা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজন করে সোনাগাছিতে। এইচআইভি, বা এইডস-এর মতো রোগ নিয়ে চালায় সচেতনতা অভিযান। তাদের কথা শুনে ক্রেতাদের কন্ডোম ব্যবহারে বাধ্য করার চেষ্টা করে মুন্নিরা। বেশি টাকা দিলে সে কন্ডোম ব্যবহারের বাধ্যবাধ্যতা থেকে মুক্তি মেলে মুন্নিদের ক্রেতাদের।
ড্রাগ-আসক্তরা আসে মুন্নিদের কাছে? মুন্নি জানিয়েছে, আসে। শুধু তাই নয়, তারা জোর করে মুন্নিদেরও ড্রাগ সেবনে বাধ্য করে। একদিনের ঘটনা মনে পড়়ে মুন্নির। সেবার এক মাদকাসক্ত জোর করে মুন্নির গলায় ঢেলে দিয়েছিল মাদক। অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল মুন্নিকে।
সোনাগাছি থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখে না মুন্নি? প্রশ্ন শুনে বলে যে ওদের স্বপ্ন দেখা মানা। রোজ খরিদ্দারের আনা গোনা, পতিতা শব্দটা তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে। স্বপ্ন দেখলেও পূরন হওয়ার আশা রাখি না ঠিক। তা ছাড়া এখান থেকে বেরিয়ে মুন্নি যাবেই বা কোথায়? এই নির্মম সত্যটা আঠারো বছর বয়সেই বুঝে গিয়েছে মুন্নি যে, সে যা-ই করুক না কেন, যত টাকাই রোজগার করুক না কেন, ‘পতিতা’বৃত্তির কলঙ্ক তার গা থেকে কোনওদিন ঘুচবে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে সে চিরকাল ‘পণ্য’ হয়েই থাকবে। তাহলে এখন কি আর কোনও স্বপ্নই নেই মুন্নির চোখে? আছে। তার ঘরে প্রায়শই আসে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার।
মুন্নিকে বিয়ে করতে চায় সে। আপত্তি নেই মুন্নিরও। সেই পুরষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে মুন্নি। আর মনে মনে গড়ে তোলে সংকল্প— কোনও দিন যদি কন্যা সন্তানের মা হয় সে, তা হলে সেই মেয়েকে যেন কিছুতেই মুন্নির মতো আর একটা বিড়ম্বিত জীবন কাটাতে না হয়। আসলে মুন্নি তো পতিতাপল্লি নিবাসী অজস্র মেয়ের একজন প্রতিনিধিমাত্র।
মুন্নির মতোই আশা ও আশঙ্কার দোলাচলে দিন গুজরান হয় আরও হাজার হাজার মুন্নির। ক’জন ভাবে তাদের কথা